ডি,আই,ইউ-তে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সফলতার সূত্র
আমাদের সমস্যাঃ
বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংই শুধু নয় সকল বিষয়ে পড়া শিক্ষার্থীর জন্য এই সূত্র গুলো বাস্তবিক পরীক্ষিত, যা শিক্ষা ক্ষেত্রে সফলতা বয়ে আনে। এই সূত্রগুলো শিক্ষাজীবনে শিক্ষার্থীকে করে তোলে জ্ঞানী ও কর্মক্ষেত্রে করে তোলে অভিজ্ঞ। আমরা অনেকেই এর অনেকগুলো জানি, তবে শিক্ষাজীবনের ধাপে ধাপে বিভিন্ন চাপের সম্মুখীন হয়ে ভুলে যাই, বা বাস্তবায়ন করার সময়ই পাই না।
বাংলাদেশে চাকরির অভাব নেই। অভাব আছে দক্ষ ব্যাক্তির। তাই পদশূন্য রেখে কম জনবল নিয়ে এগোচ্ছে আমাদের সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।অনেকে আবার গুরুতর অভিযোগ করে বসে, “ভাই মেধার মূল্যায়ন নাই, সবই ঘুস বা মামা-চাচার দ্বারা হয়। এই ধারণা একেবারেই ভুল মেধাথেকেই বেশি নেয়া হয়, বাকিটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক, আর এর হারটাও কম। আমরা সব সময় অল্প-বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে অভিযোগের সাইনবোর্ড আকারে প্রকাশ করি। এদিকে আমরা নিজেদের অদক্ষতাকে ঢাকতে চাকরি নেই বলে বেড়াচ্ছি। দেখবেন প্রতিটি প্রতিষ্ঠান চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে অভিজ্ঞ তথা কাজ জানে, পারে এমন দক্ষ কর্মী চায়। কিন্তু আমাদের দেখুন, আমরা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নিয়ে নামমাত্র সার্টিফকেট হাতে চাকরির সন্ধানে নেমে পড়ি। আর বরাবরের মতই চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে যাই।
এরপর গালি দেই, ইঞ্জিনিয়ারিং যে কেন পড়ছিলাম, অনেক সময় নিজেদের ইউনিভার্সিটিকে গালি দিতে ছাড় দেই না……. মানছি, দোষ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু আছে।কিন্তু আমরাও সবচেয়ে দোষী। কারণ, আমরা এর সমাধানের কোন চেষ্টাই করি না। এবার আসুন জেনে নেই—-কি এর সমাধান, কিইবা হতে পারে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশুনায় আমাদের সফলতার সূত্র।
সার্টিফিকেট ফ্যাক্টঃ
১. আপনি যে বিষয়ে পড়ছেন, সেই বিষয়ের ইংরেজী নামকরা রাইটারের বইগুলো পড়ুন একটু নাড়াচাড়া করুন, পড়ুন, বিভিন্ন জার্নাল সাইটে মাঝে মাঝে আপনার বিষয়ক আর্টিকেল বা জার্নাল গুলো পড়ুন। ক্লাসে শিক্ষকের পড়া বুঝতে সুবিধা হবে।
২. আপনি গ্রপ স্টাডি করুন। সমস্যা বের করুন ও সমাধান করুন প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ভাবে। দেখবেন গ্রুপ স্টাডিতে যা বুঝেছেন, তা হয়ত একজন ভালো শিক্ষকের দুই পিরিয়ডে ক্লাসেও বুঝতে পারেন নি। সম্ভব হলে গ্রুপ স্টাডিতে অন্যদের পড়ান। দেখবেন আপনাকে আলাদা করে পড়তে হবে না। সবসময় নিজের ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি অন্যের ভালো রেজাল্ট কামনা করুন।
৩. কোর্স কারিকুলাম অনুযায়ী সবজেক্টিভ টপিকগুলো একটু ইন্টারনেট ঘেটে ক্লাসের পূর্বেই দেখে যাবেন, তাহলে ক্লাসে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে পারবেন, ঐ টপিক সমন্ধে বিস্তারিত জানতে-বুঝতে-শিখতে পারবেন
৪. যাই করুন ক্লাস মিস দিবেন না। যদি ক্লাস না থাকে পারলে ক্যাম্পাসে গিয়ে এককাপ চায়ের সাথে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিন। এটাও কাজে দিবে। একে অন্যের পড়াশুনার খোজ নিন। জানতে পারবেন আপনি অন্যদের চেয়ে কতটা এগিয়ে। ক্যাম্পাসের প্রতি অভ্যাসগত ভালোবাসা তৈরী করুন।
৫. মিড ট্রামকে টার্গেটে রাখবেন, মিড ট্রামে ২০ এর মধ্যে ১০-১৫ তুলতে পারলে, আর ফাইনালে ৫০ এর মধ্যে ৩৫-৪০ তুলতে পারবে কোন টেনশন ছাড়াই আপনি ৩.৫ থেকে ৩.৮+ পর্যন্ত ভালো ফলাফল করতে পারবেন । যারা মিড ট্রামে ভালো করে, ফাইনালে তাদের রেজাল্ট অটোমেটিক্যালি ভালো হবার সম্ভাবনা থাকে।
৬. ক্লাস নোট ইজ এ বিগ থিং। ক্লাস নোট নিয়মিত করবেন, খুটিনাটি সব। পারলে ক্লাস মোবাইলে রেকডিং করুন, বাসায় গিয়ে ৫-৭ মিনিট অই নোট গুলো পড়ুন বা একবার লিখে ফেলুন।
৭. আগের সালের প্রশ্নপত্রগুলো একজায়গায় করে সাজেশন বানিয়েও পড়তে পারেন। এই কাজ আপনাকে পরিক্ষার হলে প্রশ্ন বুঝতে সাহায্য করবে।
৮. বাসায় নিজে প্রেজেন্টেশন বানাবেন ও তা প্রেজেন্টশন করবেন।
৯. যাই পড়ুন বুঝে পড়ুন
১০. প্র্যাকটিক্যাল কাজে ভালোভাবে শিখবেন
ক্যারিয়ার ফ্যাক্টঃ
১. আপনার ডিপার্টমেন্ট এ ডিপার্টমেন্টাল বা সাবজেক্ট ভিত্তিক ক্লাব বানান, দু একজন ভাল শিক্ষককে সাথে নিন। সাপ্তাহিক আলোচনা করুন শিক্ষণীয় টপিকে বা রিসার্চ করুন বা প্রজেক্ট তৈরী করুন। বিভিন্ন দেশের সাইন্সফেয়ার, সহ নানা টেক ফেয়ারের প্রজেক্টগুলো নিয়ে গবেষণা করুন। হাভার্ড, কেম্ব্রিজ এর ওপেন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট সলভ করুন। আপনার রিসার্চ পেপার পাবলিশ করুন বা আপনার প্রজেক্ট বা আইডিয়া নিয়ে বিভিন্ন ইন্টার-ইউনিভার্সিটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন। এর ফলে আপনি আপনার মেধা যাচাই করবার পাশাপাশি নিজের সিভির ভেল্যু অনেক বাড়িয়ে তুলবেন। যা পরবর্তীতে চাকুরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক।
২. আপনার ক্যাম্পাসের কিংবা পরিচিত জনের কোন ডিভাইসের বা কোন সমস্যা হল। তা আপনার সাবজেক্টের দ্বারা সমাধান করা সম্ভব হলে, সমস্যার সমাধান করুন। বাস্তব জ্ঞান লাভ করবেন।
৩. সহপাঠী, সিমিলার-ব্যাচ সিনিয়র, জুনিয়র, এলুমনি ভাই-বোনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। কল করুন। জীবনে যার যত নেটওয়ার্কিং পাওয়ার বেশি, সে তত বেশি সফল। চাকুরি হোক, বিপদ-আপদ সব ক্ষেত্রেই পেয়ে যাবেন সমাধান। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক বাড়ান। একজন শিক্ষকের অনেক লিংক থাকে, তিনি চাইলে অনেক ভালো চাকুরিতে রেফার করার পাশাপাশি ক্যারিয়ারে সফলতায় বিশাল ভুমিকা রাখতে পারেন।
৪. অনেকে ইউনিভার্সিটি মানে শুধু পড়াশুনার স্থানের কথা মনে করেন। কিন্তু এটা শুধু পড়াশুনার স্থান না, এটা জীবনকে উপভোগ করা শেখায়, জীবনে সফল হওয়া শিখায়। আর এই শিক্ষা পেতে হলে এক্সট্রাকারিকুলাম এক্টিভিটিস এর বিকল্প নেই। তাই বনভোজন, শিক্ষাসফর, পিকনিক, ক্লাস-পার্টি, কনফারেন্স, সেমিনার, খেলাধুলা সহ সব জায়গায় নিজের উপস্থিতির জানান দিন। কেউ না গেলেও একাই যান।
৫. আপনার সিভি নিয়মিত আপডেট করুন। আর আপনার কাঙ্খিত চাকুরির মার্কেটপ্লেস রেগুলার এনালাইসিস করুন। আর খেয়াল রাখুন ওই জব পোস্ট গুলোতে যে যোগ্যতা চাচ্ছে- সে তুলনায় আপনি কতটুকু কাজ শিখেছেন। যা পারেন না, তা আজ থেকেই শেখা শুরু করুন। মনে রাখবেন আপনার সার্টিফিকেট এর দাম অতি সামান্য যা কেবল সরকারী চাকুরিতেই মূল্যায়িত হবে। আর কাজের মূল্যায়ন সব জায়গায়। তাই আপনার ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাজ শিখে ফেলুন। ভুলেও খিচুরি হবেন না। এর অর্থ—এটা একটু পারেন , ওই কাজ একটু পারেন, কিন্তু কোন কাজ এক্সপার্ট লেভেলের পারেন না। তাই বিরিয়ানি হোন। খিচুরি সবাই রান্না করতে পারে, বিরিয়ানি পারে না। অর্থাৎ আপনি যে সেক্টর নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চান সেই সেক্টরে প্যাসোনের সঙ্গে এক্সপার্ট লেভেলের কাজ করতে শিখুন।
৬. নিয়মিত বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ইন্টারভিউয়ের প্র্যাকটিস করবেন। এতে করে নিজের জড়তা কাটবে। ইন্টারভিউ বোর্ডে শতভাগ সফলতা আপনি পাবেন।
৭. যদি ইন্টার্নি করেন- ইন্টার্নি বড় কোন প্রতিষ্ঠানে করুন, তবে অবশ্যই সেটা যেন আপনার বিষয়ভিত্তিক হয়। ইণ্টার্নিতে অনেক সময় পাওয়া যায়, পড়া, কাজ এগূলোর চাপ কম থাকে। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে আপনার উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলুন। যেখানে যেখানে কাজ করছেন, সেখানে সেখানে সব মানুষের সাথে ভাব জমান তাদের কাজে সহয়তা করুন। আপনি এডভান্স লেভেলের কাজ শিখতে পারবেন। জানার পরিধিও বাড়বে।
৮. ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিটে আপনার বিষয় ভিত্তিক কোম্পানিগুলোতে যান। কমপক্ষে ৪ জনের টিম বানিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিটে যাবেন। একজন ভেল্যু কালেক্ট করবেন, একজন কনভারসেশন করবেন, একজন ছবি-ভিডিও সংগ্রহ করবেন, একজন দ্রুত এনালাইসিস এন্ড কোশ্চেন প্রিডিফাইন করবেন। সঙ্গে একজন শিক্ষক গেলে আরো উপকৃত হবেন। আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থায় ৩০ বা ৫০ জনের টিম নিয়ে কখনোই যাবেন না। যাবার আগে অফার লেটার, এক্সসেপ্টেন্স লেটার, ভিজিটিং আইডি কার্ড, ইউনিভার্সিটি আইডি কার্ড, যথাযত ফরমাল ড্রেসাপে যেতে হবে। প্রতি সেমিস্টারে সম্ভব হলে একটি করে প্রতিষ্ঠানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিটে যান। অন্তত দুই সেমিস্টার পরপর অবশ্যই একবার যাবেন।
৯. আপনি যে বিষয়ে পড়ছেন সে বিষয়ের কর্মক্ষেত্র গুলোতে সিভি/বায়োডাটা/রিজিউম ড্রপ করুন বা আবেদন করুন, বিনা পয়সায় কাজ করে দেয়ার জন্য।প্রয়োজনে আপনি কিছু টাকা দিন ওই প্রতিষ্ঠানকে। এর মাধ্যমে আপনি আপনার সাবজেক্টের রিয়েল প্র্যাকটিস করতে পারবেন ও প্রফেসনাল কাজ শিখতে পারবেন। খবরদার, দু’তিন মাস পড়ে মাইনে বা বেতন চাইবেন না। শিখতে থাকুন প্রতিদিন বা সপ্তাহে তিন বা চার দিন করে। শিখতে শিখতে আর কোন নতুন শিখার কিছু পাচ্ছেন না তখন ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আরো বড় প্রতিষ্ঠানে একইভাবে আবেদন করুন কাজ শিখুন। এভাবে আপনার দুই বা তিন বছর পার করুন। ভুলেও এর মাঝে পার্ট টাইম ইনকামের জন্য লাফালাফি করবেন না। কারণ, যারা ইনকাম করে তারা আর শিখতে পারে না। তৃতীয় বা চতুর্থ বছরে পার্ট-টাইমের কাজের জন্য ঐ প্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোথাও যোগ দিন। কাজ করতে থাকুন, আর শিখতে থাকুন।
১০. বিএসসি শেষ হবার পর, ফুল টাইম কাজে ঝাপ দিন। আপনার দক্ষতা অনুযায়ী, আপনি আপনার সেলারি নিজেই নির্ধারণ করুন, আর ভাল প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করুন। এখানেই আপনার সফলতার জীবন শুরু হল। আর হ্যা, অবশ্যই ডি,আই,ইউ এর এল্যামনাই এসোসিয়েশানে যোগ দিবেন।
সূত্রগুলো পালন করা এমন কোন কঠিন কাজ নয়, আর যদি কঠিন মনে হয় তো হল। এতে আপত্তি করবেন না। সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এটা মেনে চলবেন। আপনি পড়ছেন, শিখছেন–এর মাঝে আপনার অনেক ফ্রেন্ড কে দেখবেন যে তারা ভাল টাকার চাকরি করছে। আর আপনি শিখছেন। চিন্তা করবেন না, আপনি যখন চাকরি করবেন তখন দেখবেন তাদের চেয়ে আপনার স্যালারি এতটাই বেশি হবে যে আপনি ওই ফ্রেন্ডগুলোকে দু-থেকে তিন মাসেই ক্রস করে ফেলবেন। কারণ, আপনার অভিজ্ঞতাটার দামটা অনেক বেশি।
আপনার সফলতায় মগ্ন হয়ে থাকবেন না, এরপর এম,এস,সি ও এম,বি,এ করুন ভালো ইউনিভার্সিটি থেকে। আমাদের ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতেও এখন এম,এস,সি করা যায়, আর এখানকার এম,বি,এ-ও অনেক ভালো, চাইলে এখান থেকে উচ্চ শিক্ষার শেষ ধাপটা পার হতে পারেন।
সময় আপনাকে সন্মান, ক্ষমতা দেবে, জীবন হবে সফলতায় পরিপূর্ণ। এরপর একটি কাজই বাকি সেটা হলো-আপনার পেছনের সফলতার পেছনের ইউনিভার্সিটি, ভাই-ব্রাদার, শিক্ষক, প্রতিটা মানুষ কাউকেই ভুলে যাবেন না। সবসময় তাদের সহায়তার পাশাপাশি, তাদের সবকিছুতে নিজেকে পাশে রাখুন। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন—ডি,আই,ইউ-য়ের সকল বি,এস,সি ইঞ্জিনিয়ারদের উন্নতি প্রত্যাশায়-আজ এইটুকুই। পরেরবার আলোচনা করব নতুন কোন বিষয় নিয়ে।